জিম্মি থেকে মুক্তি, সেই দুঃস্বপ্নের বর্ণনা দিলেন নাবিকসোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে দীর্ঘ ৩৩ দিন বন্দি থাকার পর গত ১৪ এপ্রিল মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ ও এর ২৩ নাবিক। অবশেষে জাহাজটি বাংলাদেশের পথে যাত্রা শুরু করেছে। জলদস্যুদের আক্রমণের দিন থেকে মুক্তি পর্যন্ত দীর্ঘ এই ৩৩ দিনে যা ঘটেছিল সেসব দুঃস্বপ্নের অকপট বর্ণনা দিয়েছেন জাহাজের চিফ অফিসার মো. আতিক উল্লাহ খান। একটি জাতীয় গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান বিস্তারিত। নিম্নে সেটি তুলে ধরা হলো:সোমালি জলদস্যুদের কথা শুনলেও তাদের শিকার যে আমরা হবো সেরকম কখনও ভাবিনি। মানসিকভাবে আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। রমজানের দ্বিতীয় দিনে সকাল ৮টার দিকে ডিউটি শেষ করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম কেবিনে। এ সময় হঠাৎ অ্যালার্মের শব্দে জেগে উঠি। রুম থেকে দ্রুত বের হতে হতেই জলদস্যুরা জাহাজে উঠে পড়ে। সবকিছু এত দ্রুত ঘটেছিল, আমরা কোনো প্রস্তুতি নেয়ার সময় পাইনি।জলদস্যুরা হুড়োহুড়ি করে জাহাজে উঠে পড়লে সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমরা জানতাম, সোমালি জলদস্যুরা কিছু বিশেষ কিছু পরিস্থিতি বাদে সাধারণত নাবিকদের ক্ষতি করে না। তবে জলদস্যুদের গুলি চালানো ও নাবিকদের মারধরের ঘটনা শুনেছি। তাই অনেক চাপের মধ্যে ছিলাম, কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়।প্রথমে ১২ জন সশস্ত্র জলদস্যুকে দেখতে পাই আমরা। পরে পর্যায়ক্রমে আরও অনেক জলদস্যু জাহাজে ওঠে। ছিনতাইয়ের দিন মোট ৬৫ জন জলদস্যু ছিল। তাদের কেউ ইংরেজি বলতে পারত না। তারা নিজেদের ভাষায় চিৎকার করছিল আর আমাদের ভয় দেখানোর জন্য ফাঁকা গুলি ছুড়ছিল। তবে তারা কাউকে মারধর করেনি। আমাদের জিম্মি করার পর আমরা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করি।পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে আমরা দ্বিধাবিভক্ত ছিলাম। তারা উদ্বিগ্ন হবে। চিন্তা করবে। এই চাপ সহ্য করতে পারবে না। এমনটা ভেবে প্রথমে আমরা পরিবারকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিই। তখন সবাই পরিবারকে বার্তা পাঠিয়েছিলাম, জাহাজের ওয়াইফাই সংযোগ বিকল হয়ে যাওয়ায় আমি দুই থেকে তিন মাস তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব না।জলদস্যুরা শিগগিরই আমাদের ব্রিজে জড়ো করে সবার মোবাইল ফোন দিয়ে দিতে বলে। তবে কিছু নাবিক তাদের ফোন লুকিয়ে রেখেছিলেন। ওগুলোর মাধ্যমেই আমরা পরে আমাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি।জলদস্যুরা আমাদের সবাইকে ব্রিজে অবস্থান করতে বাধ্য করেছিল। গাদাগাদি করে থাকার পাশাপাশি আমরা ২৩ জন এবং ১২ জলদস্যু ব্রিজের একমাত্র ওয়াশরুম ব্যবহার করতাম। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর এবং একটি কঠিন পরিস্থিতি ছিল। ছিনতাইয়ের ১২ ঘণ্টার মাথায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ এবং একটি বিমান আমাদের জাহাজের কাছাকাছি এলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক মোড় নেয়। জলদস্যুরা আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়। পুরোটা সময় আমাদের এক ইঞ্চিও নড়তে দেয়া হয়নি। এমনকি শৌচাগার ব্যবহারও করতে দেয়নি আমাদের।ইইউ নৌবাহিনী জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ করতে বলে, না হলে আক্রমণ করার হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু জলদস্যুরা রাজি হয়নি। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অনেকটা অচলাবস্থায় পরিণত হয়। এ সময়টা আমাদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্ত ছিল। অভিযান চালানো হলে ইইউ নৌবাহিনী এবং জলদস্যুদের ক্রসফায়ারে পড়ার ভয় ছিল।এক পর্যায়ে জলদস্যুরা আত্মসমর্পণ না করলে গুলি চালানোর হুঁশিয়ারি দিয়ে ইইউ নৌবাহিনী কাউন্টডাউন শুরু করে। কাউন্টডাউন শেষে তারা ফাঁকা গুলি ছুড়েছিল। এতে জলদস্যুদের উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। জলদস্যুরা ক্যাপ্টেনকে ভিএইচএফের (রেডিও) মাধ্যমে ইইউ নৌবাহিনীর সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য করে এবং নৌবাহিনীকে ঘটনাস্থল ছেড়ে যেতে বলে। ইইউ নৌবাহিনীর জাহাজ না গেলে তারা আমাদের মেরে ফেলবে বলেও হুমকি দেয়।প্রায় আধাঘণ্টা পর নীরব হয়ে যায় ইইউ নৌবাহিনী। কিন্তু যুদ্ধজাহাজটি আমাদের জাহাজের পাশাপাশি চলতে থাকে। জলদস্যুরা আমাদের কঠোর নজরদারিতে রাখে। আমরা সারারাত ঘুমাতে পারিনি। আমরা সবাই নামাজ পড়তে থাকলাম। এমন পরিস্থিতিতে আমরা সবাই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলাম। পরিবারকেও আমাদের ছিনতাইয়ের বিষয়টি জানাতে পারিনি।এদিকে আমাদের একজনের কাছে বাড়তি মোবাইল ফোন ছিল। কিছু ওষুধ আনার অনুমতি নিয়ে আমরা নিচে গেলাম। ইন্টারনেট চেক করে তিনি দেখতে পান, আমাদের পরিবারসহ সারা বাংলাদেশ আমাদের জাহাজ ছিনতাইয়ের কথা জানতে পেরেছে। সাংবাদিক ও সরকারি সংস্থা আমাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিল। পুরো বাংলাদেশ আমাদের পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে জেনে আমরা কিছুটা আশ্বস্ত হলাম।প্রথম তিন-চার দিন আমরা প্রচণ্ড চাপে ছিলাম। একটি ছোট ঘরে ২৩ জন লোক। কেবল সেহরির সময় আমাদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেয়া হতো। যাদের কাছে বাড়তি গোপন মোবাইল ফোন ছিল, তারা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারত। আমরা সবাই আমাদের পরিবারের সঙ্গে এক বা দুই মিনিট কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। তবে চার-পাঁচ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ততদিনে আমরা বন্দুকের মধ্যে ওই ঠাসা ব্রিজে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।২০১০ সালে আমাদের কোম্পানি এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলো এবং তারা তিন মাসের মধ্যে এটিকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হয়। এজন্য আমরা কিছুটা আশ্বস্ত ছিলাম এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম যে, অন্তত দুই থেকে তিন মাস আমাদের জিম্মি থাকতে হবে। আমরা পানি-খাবারের মতো প্রয়োজনীয় সব রসদ দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমাদের এক মাসের জন্য পর্যাপ্ত খাবার এবং পানি ছিল। জাহাজে লোকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রথম থেকেই খাবার ও পানির রেশনিং শুরু করতে হয়েছিল। আমরা জলদস্যুদের সঙ্গে পরামর্শ করে সীমিত পানি ও খাবারদাবারের ব্যবস্থাপনার জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করি।আমরা সাধারণত দুই থেকে তিন দিন; সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের জন্যে রেশনিং অবলম্বন করি। কিন্তু এতদিন ধরে রেশনিং করার অভিজ্ঞতা আমাদের ছিল না। সাধারণত আমরা জাহাজে আমাদের দৈনন্দিন রুটিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কাজ করি, বিশ্রাম নিই এবং আমাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলি; এগুলোই আমাদের প্রতিদিনের রুটিন। যখন জাহাজ হাইজ্যাক করা হয় এবং আমরা জিম্মি হই, তখন আমাদের একমাত্র কাজ ছিল ব্রিজে বসে থাকা। আমাদের আর কিছুই করার ছিল না।আমাদের নিয়মিত কাজের রুটিন ভেঙে গেল। পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে না পেরে সময় কাটছিল না। এক-একটা দিনকে সপ্তাহের মতো লাগত। ভালো করে ঘুমাতে পারতাম না। আমরা মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। এটি একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতি ছিল। আমরা নিশ্চিত ছিলাম না যে, আমাদের কতদিন ধরে এর মধ্য দিয়ে যেতে হবে।প্রথম থেকেই আমরা জলদস্যুদের সঙ্গে ভাল আচরণ এবং সহযোগিতা করছিলাম। এক সপ্তাহ পর এর ফল পাই। তারা দিনের বেলায় নামাজ, ইফতার এবং অন্যান্য কাজের জন্য আমাদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে দিতে শুরু করে। রাতে আমরা ব্রিজে ফিরতাম। এবার একটু নিশ্চিন্তবোধ করা গেল। পালাক্রমে আমাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলাম। মানসিকভাবে কিছুটা ভালোবোধ হচ্ছিল।এদিকে জলদস্যুরা আমাদের অবাধে চলাফেরা করতে এবং দিনের বেলা কেবিনে যাওয়ার অনুমতি দেয়। সে সময় কোনো আলোচনার কথা আমরা জানতাম না। গণমাধ্যম ও আমাদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ঈদের আগেই আলোচনা শেষ হতে পারে। কিছুটা খুশি হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু ঈদের আগে যখন তা শেষ হলো না, তখন আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। ভেবেছিলাম ব্যাপারটা নিছক গুজব ছিল।জলদস্যুরা আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানত। আমরা রোজা রাখতাম, নিয়মিত নামাজ পড়তাম; তাই ঈদের দিন এলে তারা আমাদের ঈদের জামাতে নামাজ পড়তে, এমনকি উদযাপনও করতে দেয়। তাদের অনুমতি নিয়ে আমরা একটি গ্রুপ ছবি তুলি, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তবে এতে নাখোশ হয়েছিল তারা। এরপর থেকে আমাদের চাপ দিতে শুরু করে।ঈদের একদিন পর জাহাজের পরিবেশ পালটে যেতে থাকে। আমরা তাদের গতিবিধিতে পরিবর্তন লক্ষ্য করি। তারা বাড়ি ফিরে যাওয়ার খুশিতে ছিল বলে মনে হচ্ছিল। আমরা আশা করছিলাম, ভালো কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তারা আমাদের ছবি ও ভিডিও তুলে নেয়, যা একটি ভালো লক্ষণ ছিল। পরদিন তারা আমাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে একটি ভিডিও করে। ততক্ষণে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমাদের কোম্পানির সঙ্গে হয়তো আলোচনা শেষ হয়েছে।১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ১১টায় একটি বিমান এসে আমাদের জাহাজের ওপর চক্কর দিতে শুরু করে। জলদস্যুরা আমাদেরকে লাইনে দাঁড়াতে বলে। তাদের দোভাষী চিৎকার করে বলে, ‘হাত নাড়ো’। আমরা হাত নাড়লাম। প্লেনটি সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি নেমে আসে। এরপর আমরা প্লেন থেকে জলে কোনোকিছু পড়ার তিনটি শব্দ পরপর শুনতে পাই। সেদিন রোদ খুব কড়া ছিল। কী হচ্ছিল তা ভালো মতো দেখতে পাইনি। তারপর জলদস্যুদল উল্লাস শুরু করে।শেষ দুই-তিনদিন আমরা খুব বিধিনিষেধের মধ্যে ছিলাম। আমরা আলোচনার বিষয়ে কিছুই জানতাম না কারণ এটি অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে করা হয়েছিল। যখন আমরা জানতে পারি যে জলদস্যুরা জাহাজ ছেড়ে যাবে, আমরা এতই স্বস্তি পেয়েছিলাম ও উত্তেজিত ছিলাম যে ঘুমাতে পারিনি। যদিও তারা দিনের বেলা জাহাজ ছেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, শেষে ১৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টার দিকে জলদস্যুরা জাহাজ ত্যাগ করে।সে সময় আমাদের মধ্যে স্বাধীনতার এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। আমরা খুব খুশি ছিলাম। একটা বোঝা আমাদের বুক থেকে নেমে গেল। ক্লান্তি এবং মানসিক অবসাদ পেছনে ফেলে আমাদের স্বাভাবিক জীবনে পুনরায় ফিরতে শুরু করলাম।গত এক মাস আমরা প্রচণ্ড অশান্তির মধ্য দিয়ে গেছি, পুরো ঘটনাটি প্রায় একটা দীর্ঘায়িত দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। এমনকি পরে যখন আমরা জেগে উঠতাম, আমাদের মনে হতো আমরা তখনও বন্দি অবস্থায় আছি। জলদস্যুরা আছে কিনা তা দেখতে আমরা বারবার ব্রিজের দিকে যেতাম। একমাস ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে থাকায় আমরা তখনও জাহাজের চারপাশে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছিলাম। এ দুঃস্বপ্ন আমাদের কতদিন তাড়া করবে সেটা বুঝতে পারছিলাম না।এখন মুক্তি পাওয়ার পর আমরা আমাদের নিত্যদিনের কাজে মনোনিবেশের চেষ্টা করছি। জলদস্যুরা জাহাজের ভেতর সব উলটপালট করে রেখে গেছে। আমরা এখন সব আবর্জনা পরিষ্কার করছি, সবকিছু পুনর্বিন্যাস করছি। আশা করছি দু–তিনদিনের মধ্যে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব। আমরা প্রচণ্ড মানসিক ট্রমার মধ্যে ছিলাম। কিন্তু এখন একটা স্বস্তির অনুভূতি হচ্ছে। আমরা এখন পরিবার এবং আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলতে পারছি। পুরো ঘটনায় তারাও ট্রমায় ভুগছেন।